শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৩:০২ অপরাহ্ন

জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবি…….!!!

জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবি…….!!!

আন্দালিব আয়ান: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠায় সাহাবিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সাহাবিদের প্রশংসায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে তারাই সবচেয়ে ভালো মানুষ যাদের মাঝে আমি প্রেরিত হয়েছি।’ বিশেষ ‘দশজন’ সৌভাগ্যবান সাহাবি ছিলেন, যারা তাদের বিশেষ আমল এবং সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে পার্থিব জীবনেই লাভ করেছিলেন ‘জান্নাত’-এর সুসংবাদ! সৌভাগ্যবান সাহাবিদের (রা.) বলা হয় ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’।
যেভাবে সুসংবাদ পেয়েছিলেন: সাহাবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন চার খলিফা। তারা হলেন, হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)। এদের পরবর্তী স্তরে রয়েছেন অবশিষ্ট আশারায়ে মুবাশশারারা। আরবি আশারা শব্দের অর্থ দশ। আর মুবাশশারা শব্দের অর্থ সুসংবাদপ্রাপ্ত। অর্থাৎ যারা দুনিয়ায় বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছেন তাদের আশারায়ে মুবাশশারা বা বেহেশেতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবি বলা হয়।
জান্নাতের সুখবর সম্পর্কে আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি মদিনার একটি বাগানে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক ব্যক্তি এসে দরজায় করাঘাত করল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার জন্য দরজা খুলে দাও এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ আমি দরজা খুলে দেখলাম, তিনি আবু বকর (রা.)। আমি তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফরমান অনুসারে জান্নাতের সুসংবাদ দিলাম। তখন তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। এরপর উমর (রা.) এলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাকে অনুমতি দাও এবং জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ এরপর উসমান (রা.) এলেন এবং অনুমতি চাইলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘অনুমতি দাও এবং জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর: ৬৭৩০)
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অন্য সাহাবিদের মধ্যে যারা বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাদের নামের শেষে জান্নাতি যোগ করে সম্বোধন করতেন। দুনিয়াতেই জান্নাতের সুখবর যারা পেয়েছেন তাদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো:Ñ
হজরত আবু বকর (রা.): হজরত আবু বকর (রা.)-এর পুরো নাম আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা আবু বকর। এছাড়া খলিফাতুর রাসুল, সিদ্দিক নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ৫৭৩ সালের দিকে, মক্কার কুরাইশ বংশের ‘বনু তাইম’ গোত্রে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল উসমান আবু কুহাফা। আর মায়ের নাম সালমা উম্মুল খাইর।
আবু বকর (রা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, অন্যান্য সবার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কিছু মাত্রায় দ্বিধা ছিল, কিন্তু আবু বকর (রা.) বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকর (রা.) ছিলেন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন প্রধান সাহাবি এবং ইসলামের প্রথম খলিফা। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান দেওয়া হয় তাকে। এছাড়া তিনি রাসুল (সা.) -এর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর পিতা ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর ইনতেকালের পর তিনি খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন।
পবিত্র কুরআনে (সুরা তওবা, আয়াত নম্বর: ৪০) আবু বকর (রা.)-কে ‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আত্মরক্ষার্থে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। আবু বকর (রা.) মিরাজের ঘটনা শোনামাত্রই বিশ্বাস করেছিলেন বলে, তাকে রাসুল (সা.) ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় আবু বকর (রা.) বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাবুকের যুদ্ধে তিনি তার সমস্ত সম্পদ দান করে দেন। আবু বকর (রা.) না জেনে দ্বীনের কোনো বিষয়ে কথা বলতে ভয় করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার ওপর কারও এমন অনুগ্রহ নেই, যার বিনিময় আমি দিইনি। তবে শুধু আবু বকর ছাড়া। আমার প্রতি তার এত অনুগ্রহ, যার বিনিময় আল্লাহ তায়ালা কেয়ামত দিবসে দেবেন। কারও সম্পদ কখনো আমাকে এতও ফায়দা দেয়নি, যতটুকু দিয়েছে আবু বকর (রা.)-এর সম্পদ।’ (তিরমিযি, হাদিস নম্বর ৩৬৬১; ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।) ৬৩৪ সালের ২২ আগস্ট ৬১ বছর বয়সে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মসজিদে নববিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজার পাশেই তার সমাধি।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.): উমর (রা.)-এর পুরো নাম উমর ইবনুল খাত্তাব। এছাড়া আমিরুল মুমিনিন ও ফারুক নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে, মক্কার কুরাইশ বংশের ‘বনু আদি’ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মাতার নাম হানতামাহ বিনতে হিশাম। উমর (রা.) ৬১৬ সালে ৩৯ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং প্রধান সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম। আবু বকর (রা.) ইনতেকালের পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন। ইসলামি আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন তিনি। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল ফারুক (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা ‘বিশ্বাসীদের নেতা’ উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। উমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের পর, প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করাতে মুসলিমরা আর বাধার সম্মুখীন হননি। ইসলাম গ্রহণের পর গোপনীয়তা পরিহার করে, প্রকাশ্যে তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাইরে আসেন এবং কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। সেদিন হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাকে ‘ফারুক’ উপাধি দেন। উমর (রা.) এমন ব্যক্তিত্ব, শয়তানও তাকে ভয় পেত। দ্বীনের বিষয়াবলিতে উমর (রা.) ছিলেন বেশ কঠোর। মহান আল্লাহর কাছে উমর (রা.) হলেন সবচেয়ে প্রিয়। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ৬৪৪ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রাসুল (সা.)-এর রওজার পাশে তার সমাধি।
উসমান ইবনে আফফান (রা.): উসমান (রা.) যিননুরাইন (দুই নূরের অধিকারী), আল-গনি (উদার), আমির আল-মুমিনুন নামেও পরিচিত ছিলেন। ৫৭৬ সালে তিনি কুরাইশ বংশের উমাইয়া শাখার জন্মগ্রহণ করেন। তার ঊর্ধ্ব পুরুষ আবদে মান্নাফে গিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তার পিতার নাম আফফান ইবন আবি আল-আস এবং মাতার নাম আরওরা বিনতে কুরাইজ।
উসমান (রা.) ‘আস-সাবেকুনাল আওয়ালুন’ (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী)। তখন তার বয়স ছিল ৩০ এর ওপরে। তিনি ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। খলিফা হিসেবে তিনি চারজন খোলাফায়ে রাশেদিনের একজন। তিনি সেই ৬ জন সাহাবির মধ্যে অন্যতম, যাদের ওপর হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজীবন সন্তুষ্ট ছিলেন। উসমান (রা.) ‘রুমা’ নামক কূপ খরিদ করে, মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। তিনি মসজিদ নির্মাণ ও প্রশস্ত করেছিলেন। ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। ৬৫৬ সালে ১৭ জুন ৭৯ বছর বয়সে তিনি প্রাণ হারান।
আলী ইবনে আবু তালিব (রা.): নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এবং আলী জান্নাতি’। (মুসনাদে আহমদ ১/১৮৭; আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ৪৬৫০) আলী (রা.)-এর পূর্ণ নাম আলী ইবনে আবু তালিব। এছাড়া বিশ্বস্ত দলপতি, আবু আল-হাসান (হাসানের পিতা), আবু তুরাব (ধূলিকণা/মাটির পিতা), আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) নামেও তার পরিচিতি ছিল। ৬০০ সালে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদে মানাফ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। তিনি মক্কার বিখ্যাত ‘হাশেমি’ বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর চাচাত ভাই ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের শুরুতেই মাত্র দশ বছর বয়সে হজরত আলী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। বালকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। বদর যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘জুলফিকার’ নামক তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। খাইবারের সুরক্ষিত ‘কামুস দুর্গ’ জয় করলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধি দেন। হজরত আলী (রা.) খোলাফায়ে রাশেদিনের একজন। ফায়সালার ক্ষেত্রে আলী (রা.) ছিলেন সাহাবাদের মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ।
তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রা.): সাঈদ বিন যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আবু বকর জান্নাতি। উমর জান্নাতি। উসমান জান্নাতি। তালহা জান্নাতি। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর : ১৫৩৪) তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রা.)-এর জন্ম ৫৯৪ সালে মক্কায়। ৬৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর মৃত্যুর সময় তালহার বয়স ছিল চান্দ্র সন অনুযায়ী ৬৪ বছর। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন ঘনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। উহুদের যুদ্ধ ও জঙ্গে জামালে (উটের যুদ্ধে) অংশগ্রহণের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.): সাঈদ বিন যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আবু বকর এবং উমর জান্নাতি। আলী জান্নাতি। তালহা জান্নাতি এবং যুবারের জান্নাতি।’ (মুসনাদে আহমদ, ১/১৮৭; আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪৬৫০)। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর উপনাম হাওয়ারিয়্যু রাসুলিল্লাহ। তার পিতার নাম আওয়াম এবং মাতার নাম সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব।
প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) অন্যতম। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী একজন সাহাবি ছিলেন। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাওয়ারি ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও খুব কমসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। দানশীলতা, উদারতা, আমানতদারিতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণে তিনি ছিলেন গুণান্বিত। প্রথম পর্বে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাদের সবার মতো হজরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)ও কাফির-মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। তার চাচা তাকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। অবশেষে দ্বীন ও ইমান রক্ষার তাগিদে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করেন। তিনি হাবশায় হিজরত করেন। হাবশায় কিছুকাল অবস্থান করেন। অতঃপর ফিরে আসেন মক্কায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করার পর, তিনিও মদিনায় হিজরত করেন। মক্কায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হজরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) এবং তালহা (রা.)-এর মাঝে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। হজরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) অল্প বয়সে ইসলাম গ্রহণ করলেও ইসলামের জন্য নিজ জীবনকে বাজি রাখতে তিনি ছিলেন অগ্রগামী।
দুঃসাহসী একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলেন হজরত যুবাইর (রা.)। বদর যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। শত্রুপক্ষের কাছে ‘যুবাইর’ নামটাই ছিল মারাত্মক ত্রাস সৃষ্টিকারী। তিনি যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সে সব ক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। হজরত যুবাইর (রা.)-এর শাহাদাতের সনটি ছিল হিজরি ৩৬। শাহাদাতের পর তার লাশ ‘আসা সিবা’ উপত্যকায় দাফন করা হয়।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.): রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ জান্নাতি।’ (মুসনাদে আহমদ ১/১৮৮; আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৬৪৯) তার মূল নাম ছিল ‘আবদুল আমর’ বা ‘আবদুল কাবা’। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান’। ডাক নাম ‘আবু মুহাম্মাদ’। আনুমানিক ৫৮০ সালে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আউফ এবং মায়ের নাম শেফা। তার পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন ‘যোহরি’ নামক গোত্রের। আবু বকর (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে ইসলামের বিষয়ে বলেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এখান থেকেই হজরত আবু বকর (রা.)-এর দাওয়াতে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হন এবং ইসলাম কবুল করেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী প্রথম ৮ জন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম।
আবদুর রহমান (রা.)-এর বিচক্ষণতার জন্য, তার সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা থেকেও মুসলিম সমাজ রক্ষা পেয়েছে। যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। তিনি মদিনাবাসীর জন্য বেশ খরচ করতেন। রাসুল পরিবারের সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। তিনি ছিলেন দুনিয়া বিরাগী এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তি। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ৩৩ হিজরি মোতাবেক ৬৫৩-৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমান জর্ডানের আম্মানে তাকে দাফন করা হয়।
সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.): রাসুল (সা.) বলেন, ‘এবং সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস জান্নাতি। (মুসনাদে আহমদ, ১/১৮৭) সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর ডাকনাম আবু ইসহাক। আনুমানিক ৫৯৫ সালে মক্কায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ওয়াক্কাস মালেক এবং মাতার নাম হামনা। তিনি ‘যোহরি’ গোত্রের লোক ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতা আমিনাও ‘যোহরি’ গোত্রের ছিলেন। সা’দ (রা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইসলাম কবুল করেন। প্রথম খলিফা হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর দাওয়াত পেয়ে সা’দ (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে হাজির হন এবং ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭তম ব্যক্তি।
৬৩৬ সালে পারস্য বিজয়ের নেতৃত্ব ও শাসনের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। ৬১৬ ও ৬৫১ সালে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীন পাঠানো হয়েছিল।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হজরত সা’দ (রা.) অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন। ওহুদের যুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে যে সমস্ত সৈনিক সাহাবা নবীজিকে হেফাজত করার জন্য তাকে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, নিজেদের জানকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, হজরত সা’দ (রা.) ছিলেন তাদেরই একজন। হজরত সা’দ (রা.) অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন সাহাবা ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদাসহ অন্য সাহাবারাও তাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। বিলাল (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে তিন বার হজরত সা’দ (রা.) আজান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি প্রথম সৌভাগ্যবান, যিনি আল্লাহর রাস্তায় তীর চালিয়েছেন। সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে উহুদ যুদ্ধের বাঘও বলা হয়ে থাকে। তিনি ৬৩৭ থেকে ৬৩৮ সাল পর্যন্ত তিসফুনের গভর্নর, ৬৩৮ থেকে ৬৪৪ সাল পর্যন্ত বসরার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিমদের পারস্য বিজয়ে নেতৃত্ব দেওয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। আনুমানিক ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঁচাশি বছর বয়সে মদিনা থেকে দশমাইল দূরবর্তী আকিক উপত্যকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মদিনার সে সময়কার গভর্নর ‘মারওয়ান’ তার নামাজে জানাজা পড়ান। মৃত্যুকালে হজরত সা’দ (রা.)-এর অসিয়ত মোতাবেক, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকালীন পরিহিত পুরনো জুব্বাটি দিয়েই তার কাফন তৈরি করা হয়।
সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা.): নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এবং সাঈদ ইবনে যায়িদ জান্নাতি।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪৬৪৯; তিরমিযি, হাদিস নম্বর: ৩৭৪৮; মুসনাদে আহমদ ১/১৮৯) সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা.)-এর ডাকনাম ‘আবুল আওয়ার’। ৫৯৩ সাল মতান্তরে ৫৯৪ সালে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম যায়িদ এবং ফাতিমা বিনতে বাজা। ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা.) তাদেরই একজন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি ছিলেন হানিফ অর্থাৎ তৎকালীন পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থাকা। একেশ্বরবাদী যারা ইবরাহিম (আ.)-এর ধর্মপদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে তখনো সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় ধরে রেখেছিল এবং তার পূর্বসূরিরাও হানিফ ছিলেন। সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা.) ছিলেন একজন বীর মুজাহিদ। তিনি ছিলেন ‘মুসতাজাবুদ দা’ওয়াহ’ অর্থাৎ তিনি দোয়া করলে, মহান আল্লাহ্ কবুলই করতেন। ৬৭৩ সালের আগস্টে প্রায় ৮০ বছর বয়সে সৌদি আরবের মদিনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.): আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আবু বকর জান্নাতি। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ জান্নাতি।’ (মুসনাদে আহমদ ১/১৮৭; আবু দাউদ ৪৬৫০) আবু উবাইদা আমর ইবনে আবদিল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রা.) তার বাবা আবদুল্লাহ’র নামে পরিচিত না হয়ে, দাদার নামে অর্থাৎ ইবনুল জাররাহ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাকে বলা হয় আমিনুল উম্মাহ বা উম্মাহর তত্তববধায়ক। আনুমানিক ৫৮১ সালে মক্কায় কুরাইশের বনু আল হারিস ইবনে ফিহর গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচারের শুরুতে নিজের কাছের সঙ্গীদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের আহন জানান। এ সময় আবু উবাইদা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত আবু উবাইদা (রা.) হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইসলামের জন্য নিজের পিতাকে হত্যা করেন। হজরত আবু উবাইদা (রা.) প্রায়ই পরকালের ভয়ে কান্নাকাটি করতেন। ওহুদের যুদ্ধে যে দশজন সাহাবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, যারা তাদের জান বাজি রেখে আল্লাহর নবীর হেফাজতের চেষ্টা করেছিলেন, উবাইদা (রা.) তাদেরই একজন। যুদ্ধ শেষে যখন দেখা গেল, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখমন্ডল জখম হয়েছে, দুটি দাঁত শহীদ হয়েছে এবং লৌহবর্মের দুটি বেড়ি গন্ডদেশে ঢুকে গেছে, তখন হজরত আবু বকর (রা.) এ দৃশ্য দেখে ছুটে এসে বেড়ি দুটি দ্রত খোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু উবাইদাহ তাকে বাধা দিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) যাতে কষ্ট না পান, তাই তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে সাবধানে বেড়ি বের করে আনলেন। কিন্তু বেড়ি দুটো মারাত্মকভাবে ঢুকে যাওয়ার কারণে উবাইদা (রা.)-এর দুটো দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। রাসুল (সা.)-এর প্রতি এ প্রেম-ভালোবাসা দেখে হজরত আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আবু উবাইদা! সর্বোত্তম দাঁতভাঙা ব্যক্তি!’ তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি। রাসুলের নির্ভরযোগ্য সাহাবি। তিনি ছিলেন রাসুলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। ৬৩৪ থেকে ৬৩৮ সাল পর্যন্ত লেভান্টের গভর্নর ছিলেন তিনি। মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ে তিনি অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। আনুমানিক ৬৩৮ সালে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হজরত সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস তার গোসল ও কাফনের ব্যবস্থা করেন। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) তার জানাজার নামাজ পড়ান। জর্ডান উপত্যকায় তার সমাধি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877